পলাতক

Image result for scared face imagesপায়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে ঘরবন্দি হয়ে বসে আছি, এদিকে কারোর পাত্তা নেই। হাতঘড়ির দিকে মুহুর্মুহু শঙ্কিত  দৃষ্টি দিচ্ছি, কিন্তু তাতে চোখ কটকট করলেও মজলিসের সভ্যদের কারো পায়ের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি না। কোথায় গেলো মর্কটগুলো? এর বাড়ি ওর বাড়ির ছাদে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে নাকি ডুগডুগি বাজিয়ে সবাইকে খেলা দেখিয়ে মনোরঞ্জন করছে? এদিকে বিবেকদাও বলিহারি। কোথায় দুটো জ্ঞানের কথা শুনিয়ে মনের অন্ধকার দূর করবে তা নয়, ঘরের কোনে গিয়ে লুকিয়েছে বেমালুম। কি জঘন্য এ জীবনের জ্বালা! সিলিঙের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেই কানের কাছে বিহারীদের ফিসফিসানি শুনতে পেলাম, “কেউ আসবে না মনে হয় আজ, আলুর চপ আর সিঙ্গাড়াগুলো নিয়ে কি করি বলতো?”

‘দেরি হচ্ছে বটে কিন্তু ওরা আসবেই.. ‘ আমার গলাটা হালভাঙ্গা জাহাজের নাবিকের মতো শোনায় কি? বিহারীদা অন্দরমহলে মিলিয়ে যেতেই আমি পকেটে হাত ঢুকিয়ে গুপিযন্ত্র বার করি, এটাই আমার শেষ অস্ত্র। ‘আলুর চপ, সিঙ্গাড়া, মোহনভোগ এবং জিলিপি রেডি-‘ গ্রূপে মেসেজ পাঠিয়ে সবেমাত্র ফোনটাকে পকেটস্থ করছি এমন সময় হঠাৎ দরজায় গলাখাঁকারির শব্দ। চোখ তুলে দেখি লেবু, জুতোজোড়া খুলে ঘরে ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। “এই সময় হলো তোর আসার? বেয়াক্কেলে কোথাকার!” আমি খিঁচিয়ে উঠি। কি মুশকিল, আমার আগুনে মেজাজকে সহজেই ডজ করে লেবু আমার কাছে চলে আসে, বেশ সাবধানে কানের কাছে  মুখ এনে ষড়যন্ত্রীর মত হাবভাব করে বলে, ‘রনিনদা, একটা খবর আছে, খুব গোপনীয় কিন্তু-‘। ‘আ মোলো যা, কি এমন গোপন খবর রে?’ আমি উৎসুক হয়ে উঠি। আবার এদিক ওদিক চোরের মত চাহনি দিয়ে লেবু ফিসফিস করে ঘোষণা করে, ‘ভাংচুর ক্লাবের সামনে কিন্তু কয়েকশো লোক জমায়েত হয়েছে-‘  । ‘তো?’ আমি ভ্যাবলা মেরে লেবুর গোলপানা মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি। যতদূর মনে পড়ছে স্কুলে মাস্টারমশায়দের মুখের দিকে এভাবেই তাকিয়ে থাকতাম যদি ভুলেও কেউ আমাকে কোনও প্রশ্ন করে বসতেন। তা সে যাই হোক, আমার অজ্ঞতায় হতাশ লেবু এবার মরিয়া হয়ে ওঠে, ‘প্রলয় আসছে-‘ । এবার কিন্তু আমার শরীর জুড়ে কাঁপুনি দেখা দেয়, মনিদুটো বোধকরি আর চোখের কোটরে থাকতে না পেরে মার্বেলের মত মেঝেতে পড়ে যাবে। ‘প-প-লয়-‘ আমি তোতলাতে থাকি। ‘পলয় নয়, প্রলয়, সঙ্গে প্রায় আরো শ’খানেক শাজোয়ান ছেলেপুলে।’ ‘এবার কি উপায়?’ আমি ডুকরে উঠি। আমাকে অভয় দিতেই বোধহয় লেবু দুহাত নাড়ে, ‘হারুদা আর গামছা এসে পড়লো বলে, লুকিয়ে অন্যপথে আসছে তো, তাই একটু দেরি হচ্ছে, এদিকে আঁধুলি ওর মামাবাড়িতে শেল্টার নিয়েছে। ওখানেই সবাই মিলিয়ে সেঁদিয়ে যাবো কয়েকদিনের জন্য। বুঝলে তো?’ আমার মুখ খোলা থাকে, মাথা নড়ে এদিকে এবং ওদিকে। ‘দাঁড়াও, এক মিনিট গলির মুখে গিয়ে দেখে আসি অবস্থাটা কি রকম-‘ গুপ্তচরের মত নিঃশব্দে লেবু বেরিয়ে যায়।

 

ওর ফিরে আসার আগে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখা ভালো প্রলয় পাশের পাড়ার ডানপিটে ছোকরা, ইয়া বড় ডাম্বেল ভাঁজা বাইসেপ তার, বেশ হাঁকডাক করে দুর্গাপুজো করে তাদের পাড়ায়। তা এই ডাকাবুকো প্রলয়ের সঙ্গে আমার মত ছাপোষা পেটমোটা অলস যুবকের কি সম্পর্ক? বলছি, বলছি। আসলে বিবেকদার পাল্লায় পড়ে সমাজ সংস্কারের ভূত চেপেছিল মাথায়, সেই হুজুগে পড়ে কোথাও ফাঁকা জায়গা পেলেই গাছের চারা বসিয়ে আসছিলাম আমরা সবাই মিলে। বেশ ভালোই চলছিল ব্যাপারটা, গোল বাঁধলো ভাংচুর ক্লাবের পাশে ফাঁকা মাঠের পাশটাতে গাছ লাগাতে গিয়ে। গাছপালায় নাকি ঝোপঝাড় বাড়বে আর তাতে নাকি ওনাদের আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড়দের খুব অসুবিধা হবে। আমি ততক্ষনাৎ চলেই আসছিলাম কিন্তু ত্যাঁদড় গামছা কিছুতেই মানবে না, সঙ্গে জুটলো হারুও। ব্যাস আর যায় কোথায়, দেখতে দেখতে ভিড় বাড়লো, পাল্লা দিয়ে চেঁচামেচিও। আমিও মাথা গরম করে ফেললাম, লেবু আর আঁধুলিও বেশ করে আমায়  উসকে দিলো। ‘ভাংচুর, এটা আবার ক্লাবের নাম হলো? তোদের ক্লাবের লোকেরা শুধু ভেঙে চুরে বেড়ায় না কি ভাং খেয়ে চুর হয়ে থাকে সবসময়?’ মুখ ফস্কে বেরিয়ে গিয়েছিলো কথাটা। উত্তেজনায়। ব্যাস, সবাই হৈ হৈ করে উঠলে তাই শুনে? রণে ভঙ্গ দিয়ে পালতে যাবো এমন সময় কে যেন ভিড়ের মধ্যে থেকে টিপ্পনি কাটলো, ‘খুব বাঁচান বাঁচলে আজ, ভাগ্যিস প্রলয়দা নেই-‘ । আলপ্পয়ে হারুও ঝগড়াটে মুরগির মত ঘাড় বাকিয়ে বলে বসলো, ‘বলে দিস তোদের প্রলয়দাকে, রনিনদার বাড়িতে গিয়ে যেন দেখা করে আসে একবার-‘। কোনো রকমে পালিয়ে এলেও বেশ ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছি কয়েকদিন, এই বোধহয় দল বল নিয়ে প্রলয় এসে চড়াও হলো আমাদের আড্ডাতে। সামান্য শব্দেও হাঁড়ে কাঁপুনি লেগেছে, সঙ্গে দাঁত কপাটিও ফ্রি। কিন্তু ঝড় ওঠেনি। আজ উঠলো, লেবুর গোপন খবর সেটাই জানিয়ে গেলো। কিন্তু হতচ্ছড়াটা গেলো কোথায়? পালালো নাকি? আবার ঠকঠকানিটা ফিরে এলো। রবিবারের সকালে এ কি বিড়ম্বনা, হে ঈশ্বর! এমন সময় ধপাস করে একখানা শব্দ, আমি যখন আড্ডাঘর ছেড়ে অন্দরমহলের দিকে দৌড় মারবো বলে ভাবছি ঠিক তখনি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো হারু এবং গামছা, তাদের পিছনে লেবুও। স্বস্তি!

 

গামছা  ফিসফিস করে বলে, ‘তুই ঠিক দেখেছিস?’ হারু মাথা নাড়ে শঙ্কিত হয়ে, ‘একদম ঠিক দেখেছে, কয়েক শো হবেই-‘ লেবু গম্ভীর মুখে ঘোষণা করে, ‘জনা পঞ্চাশ হলে রনিনদা একই সামলে নিতো, কিন্তু-‘ । আমি ঢোঁক গিলি, মুখে বীরত্বের হাসিটা স্রেফ ধোঁকার টাটি, সেটা আমার নিখুঁত অভিনয়ে ধরা পড়ছে না নিশ্চয়? ‘আহা, ভয়ের কিছু নেই, এখন থেকে একটা টোটো ধরে আঁধুলির মামাবাড়ি, ওখানে পৌঁছতে পারলেই কেল্লা ফতে।’ হারু হাসি চেপে বলে ওঠে। লেবুর মুখ তবুও গম্ভীর, ‘আর যদি তার আগেই-‘ । আমি আরও কাঁপতে থাকি, ভাংচুর ক্লাবের সদস্যরা কি ভাঙবে? আমাকে না আমার বাড়িটাকে? কিছু বোঝার আগেই হারু এবং গামছা আমাকে চ্যাংদোলা করে ধরে, লেবু বিহারিদাকে নির্দেশ দেয়, ‘সাবধান, কেউ কিছু বললেও দরজা খুলবে না, বুঝলে-‘

 

আমি আবিষ্কার করলাম, আমি চারহাতে চেপে রাস্তার দিকে ছুটছি উর্দ্ধশ্বাসে, পিছনে লেবুর দেড়মনি শরীরের ধুপধাপ পা ফেলার শব্দ। ‘পা ভাঙার এই তোমার সময় হয়েছিল?’ হাঁপানির মধ্যে দিয়েও হারু আপসোস করে ওঠে। গামছাও গলা ছাড়ে, ‘ওহ, কি ভারী মাইরি-‘ । আমি অনন্যোপায়। অভিমানে মুখ গোমড়া করি। লেবু চিৎকার করে, ‘এই টোটো!’ । অনেক চেষ্টায় যখন একজনকে রাজি করা গেলো ততক্ষনে গলির মুখে কোলাহল। হারু ভীত ছাগশিশুর মত চিৎকার করে ওঠে, ‘জলদি, পাশের গলিটা দিয়ে সুরুৎ করে ডানদিকে, সেখান থেকে খাল পেরিয়ে বাম দিকে, তারপর সোজা-‘ । আজ হারুই ভরসা, এ তল্লাটে সব কটা রাস্তা তার হাতের তালুর মত চেনা। রাস্তার সবকটা গাড্ডার ওপর দিয়ে নাচতে নাচতে আমাদের টোটো চলেছে গজগমনে, আমরা শুকনো মুখে শঙ্কিত চাউনিতে চারপাশটা মেপে নিচ্ছি। নিজেকে তাড়া খাওয়া বিপ্লবীর মত মনে হচ্ছে বেশ।  গামছা এবার হেঁকে উঠলো, ‘ওই যে, ওই যে, লাল বাড়িটা-‘ । সবে যখন গাড়িটা দুলতে দুলতে দরজার কাছে এসে পৌঁছেছে  এমন সময় হঠাৎ, নজরে এলো, গলির সামনে বিশাল জমায়েত। তাদের একজন প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকেই। আমরা তখন চোরের মতন দরজার দিকে এগুচ্ছি, ভিড়ের মধ্যেই কেউ চেঁচিয়ে উঠলো ষাঁড়ের মত। ‘আরে ঘুঘু যে এইখানে! আর আমরা যে চাদ্দিকে হন্যে হয়ে খুঁজে মরছি!’ হারু আর গামছা সমস্বরে বলে ওঠে, ‘খেয়েছে, সর্বনাশ-‘ । ভিড়ের মুখ ঘুরে গেছে, আশপাশের বাড়িগুলো থেকে কৌতূহলী মুখ উঁকি  মারছে। হারু এবং গামছা কোনোরকমে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ধরণী দ্বিধা হও, আমি মনে মনে জানা অজানা সব ঠাকুরের নাম আউড়ে যাচ্ছি মরিয়া হয়ে। এমন সময়ে ভিড় ঠেলে যে বেরিয়ে এলো তার বপু দেখে আমার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। দুহাতের বাইসেপ আর চওড়া কাঁধ দেখে হারু আর গামছার হাত কাঁপছে, সেই কাঁপুনিতে আমিও হাওয়ায় দোদুল্যমান। ‘আমি পলয়, বুইলেননা, ছেলেদের মুখে শুনলুম আপনি দলবল নিয়ে মাঠে গাছ লাগাতে এয়েছিলেন, সেই থেকেই আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য মুখিয়ে ছিলুম-‘ পিচের ওপর পিচিৎ করে তলবের পিক ফেলে হাতদুটোকে কেতা করে মুচড়ে নিলো ‘পলয়’। সর্বনাশ, জামার বোতামগুলো ছিড়ে ছিটকে যাবে নাকি? আমি কিন্তু ততক্ষনে মাপতে শুরু করেছি, ঠিক ক’পা গেলে মামাবাড়ির দরজা? লোকটা এদিকেই এগিয়ে আসছে। লেবু বিড় বিড় করে, ‘তিন গুনলেই দৌড় শুরু-‘ ।

‘তা আমি বললাম, তোরা মাথা গরম করিস না, যাই হোক, মানুষটা তো আর খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আসেননি, তাছাড়া গাছেরও তো দরকার তাই না?’ প্রশ্ন আমাকেই করেছে সে, বুঝতে সময় লাগলেও , আমি মাথা নাড়াই। ‘এই যেমন ধরুন কেউ পটল তুললো, তাকে পোড়াতে কাঠের দরকার নেই? কেউ বেগড়বাই করলো, চাঁদা দিলোনা কিংবা অকারণে রংবাজি করলো, তালে পিঠে চাড্ডি দিতে কাঠের দরকার নেই? বলুন দেকি?’ আমার কাঁপুনি বেড়ে যাচ্ছে, তবুও মাথা নাড়াই। ‘সেই জন্যই ঠিক করলুম পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে আমরাই গাছ লাগাবো, আপনার পাড়াতেও ছেলেরা গেছে, যদিও শুনলুম আপনি নাকি লাপাত্তা, তা এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি -‘ প্রলয় বলে লোকটা তারপর ভিড়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাঁক পাড়ে, ‘জগাই, মালটা নিয়ে আয় তো-‘ । সর্বনাশ, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে একজন কাগজে মোড়া  কিছু নিয়ে প্রলয়ের হাতে দিলো। আমি কাঁপছি, আজ সব শেষ, ডুকরে উঠতে ইচ্ছে করছে গলা ছেড়ে। লোকটা কাগজের মোড়ক খুলে ছোট্ট চারাগাছ বের করে আনে, আমার মুখের ওপরে সেটাকে নাড়িয়ে বলে, ‘বাবলা গাছের চারা মশাই, আপনি যখন উপস্থিত তখন আপনার হাত দিয়েই শুভকাজটা হয়ে যাক?’

 

আর বলতে? গাছ লাগিয়ে, আঁধুলির মামাবাড়িতে পেটভরে মাংসভাত খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে টোটো চেপে যখন বাড়ি ফিরছি, তখন আমি রীতিমত নায়ক। সবাই থেকে থেকে হেঁকে উঠছে, ‘থ্রি চিয়ার্স ফর রনিনদা, হিপ হিপ হুররে-‘ । ঘরে ঢুকতেই দেখি বিবেকদা বসে আছে আরাম কেদারায় মুখ গোমড়া করে। ‘কি হলো আবার?’ আমি প্রশ্ন করি। বিবেকদা দুঃখী মুখে বলে ওঠে, ‘পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে, বরফ গলা জল ছড়িয়ে পড়ছে  সমুদ্রে-‘ । ‘সেই জন্যই তো গাছ লাগিয়ে এলাম গো, সবাই মিলে-‘ হৈ হৈ করে উঠি আমরা। বিবেকদা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, ‘গাছ লাগিয়ে এলি? এদিকে বিজ্ঞানীরা বলছে উষ্ণ আবহাওয়ায় গাছের সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় তিনগুন বাড়ছে-‘ । আমি হতাশ হয়ে বসে পড়ি, ‘এবার কি তবে হাতে কুড়ুল নিয়ে গাছ কাটতে বেরোবো নাকি!’ ‘চুলোয় যাক ওসব, বিহারীদা, সিঙ্গাড়া  আনো  তাড়াতাড়ি, পেটটা কেমন যেন করছে-‘ লেবু সব সংশয় দূর করে ঘোষণা করে। ‘বিজ্ঞানীরা করুন তাদের কাজ, আমরা করি আমাদের-‘  হারুও গলা মেলায়। দেখতে না দেখতে বিহারীদার হাতে ধরা প্লেট থেকে সিঙ্গাড়া আর চপ উধাও হয়ে যায়, ‘মিহিদানা-‘ গামছার খাবারে ভর্তি মুখের ভেতর থেকে বেরোয় শব্দটা, ‘জিলিপি-‘ হারুর কাতর আবেদন। আমার বসার ঘরে তারপর শুধু অপার নিস্তব্ধতা।

 

উপহার

“হ্যাপি বি’ডে রনিনদা-” একমুখ হাসি নিয়ে লেবুর প্রবেশ। আমিও আনন্দে বিগলিত, যাই হোক, ওরা আমার জন্মদিনটা অন্তত ভোলেনি। “থ্যাংক ইউ!” আমার উত্তর। আড় চোখে দেখে নিই ওর হাতের দিকে, নাহ কোনো উপহার নেই। মুখের হাসি বিলীন হয়না, কিন্তু মনটা ডুকরে ওঠে।  এই একটা দিনই আমি একটু উপহার প্রেমী হয়ে উঠি। এই একটা দিন আমি সকলের কাছ থেকে উপহার দাবি করতেই পারি। কিন্তু…যাক সে কথা। “আরে আরে, এইতো বি’ডে বয় সিংহাসন আলো করে বসে আছে-” হারু আর গামছার যুগপৎ আগমন এবং ঠাট্টা। এবারও আমার চোখ ওদের হাতের দিকে পড়ে। আবার মন জুড়ে মেঘ ডাকার শব্দ। ওদেরও হাত খালি! পাষন্ড, মর্কট! মনে মনে ওদের গাল দিই।

লেবু সিগারেট ধরায়, আমেজ করে ধোঁয়া ছাড়ে সিলিঙের দিকে। হারু পকেট থেকে তাসের প্যাকেট বার করে, গামছা লেবুর মাথায় চাটি মারে তারপর ঈগলের মত ছো মেরে তার সিগেরেটের প্যাকেট কেড়ে নিয়ে সেটার সদ্ব্যবহারে লেগে পড়ে। সবাইকে তাস দিতে দিতেই হারু বলে ওঠে, “বাড়িতে আজ বলে এসেছি, নো ব্রেকফাস্ট এন্ড লাঞ্চ।” গামছা চমকে ওঠে, “কেন রে? শিবরাত্রি তো অনেককাল হল গেছে, এখন তোর উপোষ করার কি হেতু?” চিমটি কাটে সে হারুকে। লেবুও লেগে পড়ে, “যাক বাবা, দেশের অন্ন বাঁচলো কিছুটা তবে।” আশ্চর্য হারু আজ নির্বিকার, “আহা, ভুলে যাচ্ছিস কেন, আজ রনিনদার জন্মদিন, আর যাই হোক আমাদের খালি পেটে ফেরাবে না।” নিশ্চিন্ত হয়ে বলে হারু। “চার কাপ স্পেশাল চা, বাপিদা। সঙ্গে নোনতা বিস্কুট।” লেবু বজ্রনিনাদে ঘোষণা করে। খুব আস্তে করে যোগ করে, “আমিও বাড়িতে বলে এসেছি, কিন্তু পেটটা কেমন করছে খিদের চোটে-“

শুধু ডাকের অপেক্ষা, আলোর গতিবেগের চেয়েও তাড়াতাড়ি কেটলি নিয়ে হাজির বাপিদা। চা বিতরণের ফাঁকে আমার দিখে তাকিয়েই লাজুক হাসি হেসে তার ঘোষণা, “হামিও আজ রান্না বান্না করি নাই।” তারপর অন্তর্ধান। আমি ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ি।

বিবেকদাও হাজির, “ওরে শাঁখ বাজা, উলু দে। আজ রনিনের বার্থ ডে -” হৈ হৈ করে ওঠে বিবেকদাও।

হেড়ে গলায় সবাই মিলে মুখে মুখে শাঁখ বাজাবার ভান করলো, হারু উলু দিচ্ছে। সে যে কি বিসদৃশ দৃশ্য তা বলে বোঝানো মুশকিল। আমি নাচার হয়ে ওদের ঠেকাতেই চিৎকার করে উঠি, “বিহারীদা, প্রথম রাউন্ড-“

কথা শেষ হবার আগেই, দরজার আড়াল থেকে বিহারীদার আগমন, হাতের ট্রে ভর্তি লুচি, আলুর দম, সিঙ্গাড়া, রসগোল্লা, অমৃতি।

হাতে লুচিটাকে মদ ভর্তি গ্লাসের মত ধরে হারু চিৎকার করে, “উল্লাস!” সবাই যোগ দেয় তাতে, এমনকি বিবেকদাও। “আঁধুলির আজ আসতে একটু দেরি হবে, ওর খাবারটা রেখে দিও কিন্তু বিহারীদা-” গামছার হঠাৎ মনে পড়ে।  আলুর দম গিলতে আমি ব্যস্ত, সেই ফাঁকে প্রশ্ন ছুড়ি, “দেরি কেন? কোন রাজকার্য করছে শুনি?”

“গিফট কিনতে গেছে তোমার জন্য, তাই-” হারু উত্তর দেয়। “আহা রে, বেচারা, ওর জন্য দুটো লুচি বেশি রেখো-” খুশিতে টগবগ করতে করতেই বিহারিদাকে অনুরোধ করি আমি।

কথাটা শেষ করবো এমন সময় আঁধুলির প্রবেশ। আমি উৎসুক হয়ে ওর হাতের দিকে তাকাই এবং বলাই বাহুল্য মুষড়ে পড়ি।  তারও হাত খালি।

বিহারীদা আঁধুলিকে খাবার পরিবেশন করছে, আমি ভাবছি এখনো আশা আছে। উপহারটা নিশ্চয় ওর পকেটে থেকে থাকবে।

“কি কেলো মাইরি, দোকান বন্ধ -” খেতে খেতেই আঁধুলি নির্বিকার মুখে বলে ওঠে। আমার আশার আলো দপ করে নিভে যায়। সেটা বোধকরি বিবেকদার অভিজ্ঞ চোখ এড়ায় না।

“আহা, মন খারাপ করে কি লাভ, উপহার তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। শোন তবে তোদের উপহার নিয়ে একটা গল্প শোনাই।” বিবেকদা পাঞ্জাবির খুটে চশমা মুছে ঘোষণা করে।  গল্প শোনা আমার তখন মাথায় উঠেছে, তবুও মাথা নেড়ে সায় জানাই। সকলেই একদম মুখ উঁচিয়ে বসে পড়ে গল্প শুনতে।

“উপহার ব্যাপারটা যুগে যুগে নানা দেশের মধ্যে সম্পর্কের বুনোট তৈরী করেছে। একটা উদাহরণ হলো, আমেরিকা এবং ফ্রান্স। আমেরিকায় যখন সিভিল ওয়ার শেষ হলো তখন বন্ধু দেশ ফ্রান্স ঠিক করলো এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটাকে স্মরণীয় করে রাখতে এমন কিছু করা দরকার যা কিনা হবে বেশ চোখ ধাঁধানো ব্যাপার। সেই মত একখানা সুবিশাল মূর্তি জাহাজে করে পাঠানো হলো আমেরিকার মাটিতে। সবকটা অংশ জোড়া লাগিয়ে যে মূর্তিটা স্থাপিত হলো সেটা আমেরিকার মুখ হিসাবে এখনো সব দেশের মানুষের কাছে পরিচিত-” নাটকীয় মুহূর্তটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলো বিবেকদা।

“নামটা বলে ফেলো -” লেবু মিনতি জানায়। হারুর গলায় ব্যঙ্গ, “আমরা গবেট মানুষ কিনা-“

“মূর্তিটার নাম হলো, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি- মশালধারী ভদ্রমহিলা। ভূতল  থেকে মশালের ডগা অব্দি যার উচ্চতা ৩০০ মিটারেরও বেশি।” বিবেকদা মিটিমিটি হাসেন।

“এবার শোন তাহলে একজন প্রেমিক তার স্ত্রীকে উপহার দিয়েছিলেন একখানা গোটা বাগান-” বিবেকদা আবার আমাদের চমকাতে চেষ্টা করেন।

গামছার তির্যক মন্তব্য ছুটে আসে, “এ আর এমনকি ব্যাপার, আমাদের পাশের বাড়ির গোপাল ময়রা তার বউকেও হাফ কাঠা জায়গায় বাগান বানিয়ে দিয়েছে।”

“বিশাল ব্যাপার ভাই , যদি প্রেমিকের নাম হয় ব্যাবিলনের সম্রাট নেবুচাদনেজার, স্ত্রীর নাম হয় এমিথিস এবং বিখ্যাত বাগানের নাম হয় ‘ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান’ যেটা কিনা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের মধ্যে একটা। ” বিবেকদার মুখে কান এঁটো করা হাসি ফিরে এসেছে, কারণ আমরা আবার সম্পূর্ণভাবে ভ্যাবলা মেরে গেছি।

মেদিয়া  থেকে স্ত্রীকে বিবাহ করে এনেছিলেন সম্রাট, কিন্তু স্ত্রী কথায় কথায় ফেলে আসা ঘরবাড়ির কথা ভেবে বিষণ্ণ হয়ে পড়তেন। এককথায় যাকে বলে homesick । তাই তাকে মেদিয়ার মত গাছ গাছালি সমৃদ্ধ বাগান উপহার দিয়েছিলেন তিনি। এমিথিস খুশি হয়েছিলেন কিনা সেটা অবশ্য জানা যায়না। পত্নীদের তো সহজে খুশি হওয়ার কথা নয়।” বিবেকদা চোখ মেরে হাসে। সঙ্গে যোগ দিই আমরাও।

“বন্ধুদেরই যে শুধু উপহার দেয় মানুষ তা নয়, শত্রূকেও দেয় -” বিবেকদার কথা শেষ হবার আগেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে, “শত্রূকেও উপহার?” বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসও বেরিয়ে পড়ে চুপিচুপি।

“দেয় বৈকি, ট্রোজান হর্স তার নাম।” বিবেকদা থামতেই হারু আর গামছা নেমে পড়ে বিদ্যা জাহির করতে, “ট্রয়ের যুদ্ধ-” তাদের থামিয়ে বিবেকদা বলে, “ঠিক আছে ঠিক আছে। এবার আরেকটা গল্প সোনায় শোন।  এটাও গ্রিসের কাহিনী, তাদের ঈশ্বরের গল্প। মহাদেব জিউস এর সঙ্গে পুত্র প্রমিথিউসের সম্পর্কটা একদম ভালো নয়। বাপের ইগোয় শান না দিয়ে ব্যাটা সবসময় নিজের তৈরী প্রাণীদের নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত। সেই প্রাণীদের নাম হলো মানুষ। বাপ এদিকে সবসময় আগুনের ক্ষমতায় বলদর্পী। ব্যাটা কিছুটা তাই বাপকে শিক্ষা দিতেই, আগুন জ্বালানোর বিদ্যা উপহার দিলেন মানুষকে। মানুষ পেলো এক অসাধারণ জ্ঞান, কিন্তু প্রমিথিউস পেলো শাস্তি। জিউস রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে নির্দেশ দিলেন, পাথরে বেঁধে রাখা হবে পুত্রকে, ঈগল ঠুকরে ঠুকরে খাবে পুত্রের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। তাই হলো, ঈগল পাখি প্রমিথিউসের পেট চিরে তার নাড়িভুড়ি ছিঁড়ে খেলো। যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠলো সে। আশ্চর্য ব্যাপার তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আবার আগের রূপে ফিরে গেলো।” বিবেকদা থামেন।

“ওহ তাহলে আর কি এমন শাস্তি হলো-” হারু ঠোঁট উল্টে বলে, তারপর যোগ করে, “জিউসকে বেশ বোকা বানিয়েছে প্রমিথিউস।”

“না, ঠিক তার উল্টো। যতবার পুত্রের জীবন ফিরে আসে ততবারই ঈগল ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ওপরে। প্রতিদিন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। এখনো বোধকরি প্রমিথিউস কোনো এক অজানা গুহায় পড়ে আছে, এখনো ভোগ করছে সেই যন্ত্রনা-” বিবেকদা থামে। “সুতরাং উপহার দেবার আগে একটু ভেবে নেওয়া প্রয়োজন কি উপহার দেওয়া উচিত, তাই সবার ইচ্ছেয় তোর জন্মদিনে দিলাম এই উপহার-” বিবেকদা পকেট থেকে ছোট একটা কৌটা বার করে ধরলো আমার চোখের সামনে। আমি বিস্মিত, হতবাক। অভুক্ত কাঙালকে যেমন গরম ভাতের হাড়ি দেখালে হয়, আমার অবস্থাও তথৈবচ। “ত-ত-বে-যে-আঁধুলি-” আমি বেজায় তোতলাতে থাকি। সবাই একযোগে বলে ওঠে, “ওটা নাটক!”

কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্স খুলে যা দেখি তাতে, আমি লাফিয়ে উঠি। কি ছিল তাতে? উঁহু বলবো না। তবে এটুকু বলতে পারি, আনন্দের চোটে আরাম কেদারা থেকে পড়ে গেছি, পায়ের গোছা মচকে গেছে।  সবাই যখন আমাকে চ্যাংদোলা করে রিক্সায় তোলার চেষ্টা করছে তখন বিহারীদের প্রশ্ন, “বলি সেকেন্ড রাউন্ডের কি হবে? হ্যাঁ ?”  আমরা সবাই মিলে বলে উঠি, “কোনো চিন্তা নেই বিহারীদা, এই এলাম বলে-“

পাগলপারা

roninerdoftorcrazy

এক দিস্তে লুচি সাবড়ে আমি ক্লান্ত। রনিনের দফতরের বাকি সভ্যদের দিকে তাকিয়ে আমি একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিই। খাওয়ার ব্যাপারে আমাকে হারানো চাট্টিখানি কথা নয়, হুম!

“প্রোডাক্ট রিলিজ হচ্ছে তো , তাই কদিন আসতে পারিনি রনিনদা। দিন রাত কাজ, শনি রবিতেও ছাড় নেই।” গোগ্রাসে গিলতে গিলতে গামছা জানাল।
“কি প্রোডাক্ট রে?” ভালোমানুষ হারু প্রশ্ন ছুঁড়লো। গামছা এই সুযোগে নিজের দুশমনি ঝালিয়ে নিলো, “এমন একটা সফটওয়্যার যা ব্যবহার করলে, যখনি কম্পিউটারে এন্টার মারবো, তখনি তোর গালে একখানা বিরাশি সিক্কার চড় এসে পড়বে। বুঝলি?”

“দেখলে? দেখলে? কিভাবে আমাকে পার্সোনাল এট্যাক করছে গামছাটা?” হারু আমার কাছে বিচার চায়।

বিবেকদা খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে যুযুধান দুই পক্ষকে শাসায়, “ওহ তোরা কাঁদা ছোঁড়াছুড়িটা একটু বন্ধ কর দেখি।”
তারপর আবার সংবাদের মহাসমুদ্রে ডুব মারে।
খাওয়া শেষ করে লেবু প্যাকেট থেকে সবাইকে সিগারেট বিতরণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর আঁধুলী বাপিদাকে চায়ের তাগাদা দেয়।
“এই জানিস, আজ ত্রিদিব বাবুকে দেখলাম ভুলুকে পিথাগোরাসের থিওরেম শেখাচ্ছেন।” লেবু আঁধুলীকে উদ্দেশ্য করে বলে। আমি এক বোকার মত চেয়ে থাকি, কিন্তু বাকি সকলেই তখন গদির উপরে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
“ত্রিদিববাবু অংকের স্যার, উনি কাউকে থিওরেম শেখাচ্ছেন এতে ভুঁড়ি দুলিয়ে এতো হাসির কি আছে?” বিরক্ত হয়ে আমি প্রশ্ন করি।
“আহা, রনিনদা, “ভুলু” স্যারের পোষা ছাগলের নাম।” হারু বুঝিয়ে বলে।
“দেখবি এবার মাধ্যমিকে স্যারের পোষা ছাগলই না একশোয় একশো মার্কস পায়। বুঝবি তখন ঠেলা।” বিবেকদা টিপ্পনি কাটে। আবার হাসির হররা। “শুনেছি অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষের নাকি ওরম বাতিক থাকে।” গামছা গম্ভীর মুখে তার বক্তব্য রাখে। হারুও কম যাবার নয়,”তাই বৈকি, নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী ফেইনমান নাকি লজিকাল প্রব্লেম সল্ভ করতে ভালোবাসতেন, তাই পারমাণবিক বোমা নিয়ে গবেষণা করতে করতেই নানা রকম তালা ভাঙ্গায় হাত পাকাতেন।”
“আমিও একটা ব্যাপার শুনেছি, রিচার্ড ফুলার যিনি একজন বিখ্যাত আর্কিটেক্ট ছিলেন, প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর নাকি নিজের কর্মকান্ড খাতায় কলমে লিখে রাখতেন। ভদ্রলোক ছেষট্টি বছর কাজ করেছিলেন এবং তার লেখা এই কার্যবিবরণী নাকি ১৪০০ ফুট লম্বা, যা কিনা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিঙের উচ্চতার সমান।” আঁধুলী নিজের জ্ঞান জাহির করতে লেগে পড়ে।
আমিই বা কম যাই কেন? গলা খাঁকারি দিয়ে আমিও নেমে পড়ি, “বিজ্ঞানী টেসলা নাকি ৩ সংখ্যাটিকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন, তাই কোনো বাড়িতে ঢোকার আগে সেই বাড়িটাকে নিয়ম করে নাকি তিনবার প্রদক্ষিণ করতেন।”
আমাদের এই আলোচনা বিবেকদার কানেও পৌঁছালো, খবরের কাগজ গুছিয়ে রাখতে রাখতে তার ঘোষণা, “তোরা কি জানিস? বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন স্নান করতে ভীষণ পছন্দ করতেন,তবে জলে নয় বাতাসে। তাই নিয়ম করে প্রতিদিন সকালে খোলা জানলার সামনে বসে থাকতেন উলঙ্গ হয়ে, ভোরের নির্মল বাতাসে স্নান করবেন বলে।” আমরা আবার গদিতে গড়াগড়ি খেলাম। মুচকি হেসে বিবেকদা আবার শুরু করে, “তবে সবসময় কিন্তু ব্যাপারটা এতটা হাস্যকর নয়। কখনো কখনো এই অদ্ভুত পাগলামিগুলো কিন্তু চরম পরিণতি ডেকে আনে। গণিতজ্ঞ কার্ট গোডেল ছিলেন আইনস্টাইনের কাছের বন্ধু। দুজনেই সমানরকমের অদ্ভুতুড়ে কান্ড কারখানা করতেন। অকারণেই কার্টের ধারণা হয়েছিল কেউ তাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে চায়। ভেবে আকুল বিজ্ঞানী অবশেষে একটা উপায় বার করলেন। অজানা কারো হাতে রান্না করা খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। একমাত্র তাঁর স্ত্রীর রান্নাই খেতেন তিনি, তাও তাঁর খাবার আগে স্ত্রীকে সেই খাবার খেয়ে প্রমান করতে হতো যে সেই খাবার নিরাপদ। কিন্তু বিধি বাম, তাঁর স্ত্রী একবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, সেখানে তাকে কাটাতে হল পাক্কা ছমাস। বেচারা বিজ্ঞানী ততদিনে প্রাণত্যাগ করেছেন না খেয়ে।”
“ইস! কিছু না খেয়ে মারা যাওয়ার থেকে ভুরিভোজ করে মরাই তো ঢের ভালো ছিল?” আমি আফসোস করে বলি।
“আসলে কি জানিস, আমরা সাধারণ মানুষ সবসময় চেনা জানা ধারণা নিয়ে একটা খাঁচা বানিয়ে তার মধ্যেই বাকি জীবনটা নিরাপদে কাটিয়ে দিই। কিন্তু ক্রিয়েটিভ মানুষেরা সবসময় নিয়ম ভাঙ্গায় এতো ব্যস্ত থাকেন যে লক্ষ্য করতে ভুলে যান বাকিরা তাঁদের নিয়ে কি ভাবছে। স্টিফেন কিং বলে ছিলেন, some birds are not meant to be caged. their feathers are too bright, their songs too sweet and wild. so, you let them go ….”, আমাদেৱ নির্বাক মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বিবেকদা উঠে পড়লো, “এবার যাই, আজ মেয়েটাকে একটু অঙ্ক শেখাতে বসতে হবে, গিন্নির দাবী।”
একে একে আড্ডাঘর খালি হলে, আমি শোয়ার ঘরের বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসতে যাবো এমন সময় বিহারীদের প্রবেশ, “ভাত বাড়ছি দাদাবাবু, স্নান করে নাও শিগগির।”
চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে আমি ঘোষণা করি,” স্নানই তো করছি! মেলা বিরক্ত করোনা এখন!” বিহারীদা গামছায় হাত মুছতে মুছতে আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায় তারপর গজগজ করতে করতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়, “যতসব পাগলামি।” আমি চোখ বন্ধ করে হাসি আর ভাবি, যাক এতদিনে আসল genius হওয়ার মন্ত্রটা শিখতে পেরেছি। এবার আমায় পায় কে?

image courtesy: Pinterest

না য় ক

“উফঃ! চিংড়িমাছের মালাইকারিটা যা হয়েছে না!”, লেবু ঢেঁকুর ছেড়ে গদিতে শরীর এলিয়ে দেয়। “আমার কিন্তু সব কটা পদ অসাধারণ লেগেছে, বিহারীদার জবাব নেই!”, চন্দনদা পেটে হাত বোলাতে বোলাত…

Source: না য় ক

না য় ক

“উফঃ! চিংড়িমাছের মালাইকারিটা যা হয়েছে না!”, লেবু ঢেঁকুর ছেড়ে গদিতে শরীর এলিয়ে দেয়। “আমার কিন্তু সব কটা পদ অসাধারণ লেগেছে, বিহারীদার জবাব নেই!”, চন্দনদা পেটে হাত বোলাতে বোলাতে ঘোষণা করে। এখানে বলে রাখা ভালো, চন্দনদা চারবাগানের ছেলে হলেও এখন কানাডাতে থিতু হয়েছে বৌ এবং ছেলেকে নিয়ে। হলিউডের কোনো এক বিখ্যাত স্টুডিওর’ সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার’ সে এখন। হ্যা, টলি নয়, বলি নয় বছর চল্লিশের এই “যুবক ” একদম হলিউডের সম্পত্তি। পাড়া গ্রামে তাই চন্দনদাই আমাদের কাছে ঘরের পাশে থাকা টম ক্রূজ। সম্পর্কে আঁধুলির
জ্যাঠতুতো দাদা হওয়ার সুবাদে এই অধমের আস্তানায় তাঁর পদার্পন। এই উপলক্ষ্যেই রবিবারের ভুরিভোজের ব্যবস্থা। বিহারীদা যত্ন করে আলু পোস্ত, মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, মোচার ঘন্ট, চিংড়ির মালাইকারি এবং খাসির মাংস রান্না করছে। চন্দনদার কল্যানে আমাদের মতো কাঙালদের কপালেও সেসব সুখাদ্য জুটেছে। খাওয়া দাওয়ার পরেই আড্ডা জমে উঠলো দুর্দান্ত, তর্ক এবং তারপর বিতর্ক। বিষয় হলিউডের সিনেমায় অনেকসময় অনেক গাঁজাখুরি গল্প দেখায়। সেখানে নায়করা সব অসাধারণ কাজ করে যা দেখলে বাস্তবকে বড্ডো খেলো দেখায়, আমরা সাধারণ মানুষরা সব হীনমন্যতায় ভুগি। হারু লেবু এবং চন্দনদা প্রমান করতে ছাড়বেনা যে সিনেমায় আমরা যা দেখি তা বাস্তবেরই একটা সত্ত্বা। বলাই বাহুল্য আমি এবং গামছা তাতে বাগড়া দিয়েছি, আমাদের বক্তব্য হলো, বাস্তবে সব কিছুই খুব ধূসর, আমরা সাধারণ মানুষরা শুধু সামান্যই নয় যথেষ্ট নগণ্যও বটে, যদিনা আমরা বিল গেটস অথবা টাটার ব্যাটা হই। আঁধুলি উশখুশ করছে, সে নিজের দাদাকেও রাগাতে চায়না আবার আমাদেরও চটাতে সাহস করেনা। আপাতত সে একবার আমাদের দিকে আরেকবার দাদার দিকে তাকিয়ে বিতর্ক উপভোগ করতে ব্যস্ত। তুমুল হট্টগোলের মধ্যে চন্দনদা হৈ হৈ করে উঠলে, “ঠিক আছে, তোদের ভুল ভাঙাতে আমার রিয়েল লাইফের একটা গল্প শোনাই। আশা করি এই গল্পটা শুনেই তোদের মাথায় ঢুকবে আমি কি বলতে চাইছি…”

আমাদের আড্ডায় এসে আমাদেরই গল্প শোনাবার আমন্ত্রণ আর কাঙালিকে শাকের ক্ষেত দেখানো, দুই সমান। আমরা বিতর্ক ভুলে একজোট হয়ে চন্দনদাকে ঘিরে বসি। তাঁর উবাচ…

“আমার বাবা ছিলেন ঘোর অবিশ্বাসী, কোনো সিনেমায় কোনো হিরো কোনো অবিশ্বাস্য কান্ড করলেই, বাবা ভ্রূ কুঁচকে বলতেন, “গল্পে গরু গাছে চড়ে ! যত্তসব।” কথাটার মানে হলো এসব আষাঢ়ে ব্যাপার শুধু গল্পেই হয়ে থাকে। শুনতে শুনতে আমিও কথাটায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু বাদ সাধলো আমাদের স্কুলের একটা ম্যাচ।” এটুকু বলেই চন্দনদা একটা নাটকীয় এবং অর্থবহ পজ মারলো। বেশ আয়েশ করে নিজেকে চেয়ারে গুছিয়ে নিয়ে আবার শুরু তাঁর ব্যাখ্যান, “সেবার আমাদের সায়েন্সের ফুটবল টীম এককথায় স্টারে ভর্তি। বিগত এগারো বছর স্কুলের ট্রফি কমার্সের ছাত্ররা হাতিয়েছে, কিন্তু এবার নয়। আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় তপু চালাক চতুর দক্ষ স্ট্রাইকার, জগার ডিফেন্স হিমালয়ের মতো অটুট, মাঝমাঠে সাধন আর পাপন অজেয়। আমরা বাকিরাও কম যাইনা। ট্রফি জেতাটা আরো সহজ হয়ে গেলো যখন আমরা কমার্সের দোর্দন্ড প্রতাপ টিমকে ২-১ এ হারালাম। এখন সামনে শুধু আর্টসএর ছাত্ররা। আমাদের কোচ ছিলেন কেমিস্ট্রির গোপাল বাবু, তিনি ঘোষণা করলেন আর্টসের দুর্বল টীমকে আমরা এবার দশ গোল দেব। কথাটা বাড়াবাড়ি নয়, ওদের টিমের যা অবস্থা তাতে আমরা বোধকরি তার থেকেও বেশি গোল দিতে পারি। সব থেকে বড় ব্যাপার ওদের মাত্র কুড়িজন ছাত্রের মধ্যে থেকে এগারোজন প্লেয়ার বাছা। বাংলার রমাপদ বাবু ওদের কোচ , তিনি উস্কে দিলেন আমাদের, ঘোষণা করলেন, আর্টসের ছাত্ররা জিতলে তিনি সক্কলকে রসগোল্লা খাওয়াবেন, নিজের খরচে। দেখতে দেখতে ম্যাচের দিন চলে এলো, আমরা ট্রফি হাতে নেওয়ার জন্যে চাঙ্গা হয়ে মাঠে নামলাম। কিন্তু আর্টসের টীম কোথায়? তপু ঠাট্টা করে বললো, “ওদের মনেহয় এগারোজন জোগাড় হয়নি।” কথাটা মিথ্যে নয়, আর্টসের এগারো নম্বর খেলোয়াড় , গোলকীপার দিনু এখনো এসে উপস্থিত হয়নি। অগত্যা দীনুকে ছাড়াই আর্টসের ছাত্ররা মাঠে নামলো অবাধ্য ঘোড়ার মতো। রমাপদবাবুকে দেখলাম সাইডলাইনে দৌড়াদৌড়ি করছেন উত্তেজিত হয়ে, কানে এলো তিনি কাউকে পাঠিয়েছেন দীনুকে সাইকেলে চাপিয়ে এক্ষুনি মাঠে হাজির করতে। রেফারির বাঁশি বাজতেই খেলা শুরু। আমাদের পায়ে বল, মুখে আত্মবিশ্বাসের হাসি। বল এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দুজনেই আমাদের পায়ে পায়ে ঘুরছে। দশ মিনিটের মাথায় সাধনের বাড়ানো পাসে তপুর অবহেলা ভোরে ছোট্ট ড্রিবলে আমাদের গোল। দর্শক ছাত্র এবং শিক্ষকদের হাততালির মধ্যেও গোপালবাবুর ঝড়কানি কানে এলো, তাড়াতাড়ি কর, দশটা দিতে হবে কিন্তু! যাই হোক , প্রথম গোলের পর আমরা সেন্টার করতে যাবো এমন সময় সাইড লাইনথেকে খেলা থামাবার রিকোয়েস্ট। দেখলাম একজনের সাইকেল থেকে দিনু হন্তদন্ত হয়ে নামছে, রমাপদ বাবু তাকে উদ্দেশ্য করে যথেষ্ট চিৎকার চেঁচামেচি করছেন, কোনোদিকে কান না দিয়ে সে হাতে গ্লাভস পরতে ব্যস্ত। দিনু মাঠে নামতেই আর্টস এবং কমার্সের ছাত্ররা হাততালি দেয়, কেউ একজন চিৎকার করে, “লড়ে যা দিনু।” তাই দেখে সাধন ইয়ার্কি মারে, “গোলকীপার তো নয় যেন স্বয়ং পেলে এসে গেছেন মাঠে।” দিনু তখন জার্সি প্যান্টের মধ্যে গুঁজতে গুঁজতে স্টপারকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলো, গোল থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে, সেটা তপুর চোখ এড়ায়নি। মাঝ মাঠ থেকে যুগলের পাস থেকে তপু শট নিলো, বল আকাশে উড়ে গেলো , দীনুর মাথার ওপর দিয়ে গোত্তা খেয়ে সোজা নেটে। হতবাক দিনু, তার মুখ লজ্জায় লাল, কমার্স এবং আর্টসের ছেলেরা মর্মাহত, সাইডলাইনে রমাপদ বাবু মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। ভিড় থেকে টিটকিরি আসছে, “বাঘ নয় এটা তো একদম বেড়াল।” আমাদের তখন আর পায় কে, আত্মবিশ্বাসে আমরা ভরপুর, পাপন কামানের গলার মতো শট নিলো ওদের গোলে, চিৎকার করে বললো , এই নে তিন নম্বরটা হজম কর। দিনু কিন্তু এবার আর ভুল করলোনা। ডান দিকে ঝাঁপিয়ে কোনোমতে গোল বাঁচালো সে। এরপর কি হলো বোঝা মুশকিল, হাফটাইম অব্দি আর্টস কোনো গোল খেলনা, মাঠের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমরা শুধু ওদের গোল লক্ষ্য করে শট মেরেছি, প্রত্যেকবার দিনু লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে সেগুলো বাঁচিয়েছে। হাফটাইমে দেখলাম, দিনু ওর টিমকে এক কোনে জড়ো করে কিসব বলছে যেন। আমি মাঠে ঢুকতে ঢুকতে তপুকে চোখটিপে বলি, ‘ভোকাল টনিক দিচ্ছে।’ সবার সে কি হাসি। খেলা শুরু হলো। আমাদের মুখের হাসি উড়ে গেছে একদম, ওদের স্কিল নেই কিন্তু হঠাৎ করে ওদের মনোবল বেড়ে গেছে একশোগুন। গতি নেই, কিন্তু জেদ বেড়ে গেছে। ম্যান মার্কিং থেকে শুরু করে ব্লকিং, স্লাইডিং ট্যাকল সব কিছুই করতে শুরু করেছে তারা। উত্তেজনার পারদ বাড়ছে দর্শকদের মধ্যেও। মাঠে তখন বল দখলের লড়াই তুঙ্গে। খেলা আর খেলা নেই , যুদ্ধে পরিণত। আমরা ওদের গোল দেবই আর ওরাও বিনা যুদ্ধে আমাদের এক ইঞ্চি এগোতে দেবেনা। দিনু এর মধ্যেই আবার কয়েকটা গোল সেভ করে ফেলছে, দর্শকরা ওর হয়ে গলাফাটাচ্ছে, ওর একার লড়াইটা বাকিদের কেমন যেন চাগিয়ে দিয়েছে। আমরা দশজনে মিলে আক্রমণে যাচ্ছি আবার দশজনে মিলে ডিফেন্স করছি। হঠাৎ করে ওদের পঞ্চা বেপরোয়া হয়ে গায়ের জোরে গোলের বাইরে একটা শট নিলো, দীপন তার থেকেও বেপরোয়া হয়ে হাওয়ায় শরীর ভাসিয়ে দিয়ে সেই বলটাকেই হেড দিয়ে গোলে ঢুকিয়ে দিলো। ফল হলো ২-১। আমাদের অবস্থা তখন দেখার মতো, জালে পড়া মাছের মত হাঁসফাঁস করছি আমরা। সেই সুযোগে আবার আঘাত, ভিড়ের মধ্যেই গোলকিপারের হাত থেকে ছিটকে যাওয়া বল গোলে ঢোকালো তপেন। ফল ২-২। রেফারি খেলা শেষের বাঁশি বাজালেন। এরপর এক্সট্রা টাইম। দশ মিনিটের এক্সট্রা টাইমও প্রায় শেষ, এমন সময় আমার পায়ে বল এলো, দুজনকে কাটিয়ে আমি তখন দীনুর সামনে, ওকে কাটালেই কেল্লা ফতে, ট্রফি আমাদের হাতে। আমি সাবধানী, সময় প্রায় শেষ, এই গোল মিস করলে টাই ব্রেকার, যেখানে আমাদের জেতার কোনো চান্স নেই। বা পায়ে মাটি ঘেঁষে শট মারলাম, বালের গতিপথ গোলপোস্টের কয়েক ইঞ্চি বাইরে। খুশি মনেই দেখলাম, দিনু এক ইঞ্চি নড়েনি, আমি জানি এই নির্বিষ শটটাই শেষ মুহূর্তে হঠাৎ সুইং করবে। করবেই করবে, আমি জানি। আমি আনন্দের চোটে দুহাত তুলি সেলেব্রেট করতে।”

এটুকু বলে চন্দনদা আবার ব্রেক কষলো, আয়েশ করে সিগারেটে আগুন ধরালো, চোখ বন্ধ করে সুখটান মারলো। আমরা অধৈর্য, “কিন্তু বলটা সুইং করলো না?”, লেবুর প্রশ্ন। হারুও থাকতে না পেরে বলে ওঠে, “গোল হলো?” গামছা নির্বাক, তার মুখ খোলা।
“বল সুইং করলো , কিন্তু দিনু ততক্ষনে শরীরটাকে স্ট্রেচ করে ঝাঁপ মেরেছে, গোল লাইনে বলটা ওর আঙুলের ডগায় ধাক্কা খেয়ে পোস্টে লাগলো, সেখান থেকে গড়িয়ে বাইরে। আর সেই সঙ্গে খেলা শেষের বাঁশি। মাঠ ভর্তি দর্শকদের সে কি চিৎকার। দিনু অলরেডি ওদের হিরো। খেলা গড়ালো টাই ব্রেকার অব্দি। টাই ব্রেকারের রেজাল্ট, ৩-৩। বাধ্য হয়ে আবার তিনখানা করে শট নেওয়া হলো, তাতেও ফল ১-১। এবার একটা করে শট। ফল ০-০। দিনু অসম্ভব সব সেভ করছে, আর দর্শক আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠছে। অবশেষে, রেফারি ঠিক করলেন, কয়েন টস করে খেলার ফয়সালা করা হবে। কয়েনটা যখন হাওয়ার বুকে পাক খাচ্ছিলো তখন কয়েকশো জোড়া চোখ, শুধু সেই ধাতুর টুকরোর দিকে একভাবে তাকিয়েছিলো। আমাদের বাইশজন খেলোয়াড়ের হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি আমি যেন শুনতে পাচ্ছিলাম। কয়েন মাটি ছুঁলো, আর আমরা হেরে গেলাম। পাগল দর্শকরা মাঠে ঢুকে দীনুকে মাথায় চাপিয়ে ততক্ষনে স্লোগান দিতে শুরু করেছে। সেই ভিড়ের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা এগারোজন সকলের চোখে জল। আমার চোখও ভিজে, তবে আনন্দে, দর্শকদের মতোই আমিও কখন দীনুর দলে ভিড়ে গেছিলাম। সেই প্রথমবার আর্টস টীম ট্রফি জিতলো স্কুলের ইতিহাসে। সত্যি সত্যিই নিজের চোখে গরুকে গাছে চড়তে দেখলাম প্রথমবার।”, বিষণ্ণ গলায় কিন্তু হাসিমুখে বললো চন্দনদা।

আড্ডা শেষে সিঁড়ি টপকে শীষ দিতে দিতে শোয়ার ঘরে পা বাড়ালাম। মনে মনে পরিকল্পনা এঁটে নিয়েছি, যাই হয়ে যাক, আমার গল্প লেখার স্বপ্নটাকে সত্যি করতে হবেই। মনের জোর আর আত্মবিশ্বাস থাকলে পৃথিবীতে অসম্ভব কিছুই নেই। ওহ বলতে ভুলি গেছি মনে মনে সবার অগোচরে আমিও চন্দনদার মতোই অবিশ্বাসীদের জার্সি খুলে ফেলে বিশ্বাসীদের দলে ভিড়ে গেছি। ভাগ্যিস কেউ দেখতে পায়নি, আমি জীভ কাটি, মনে মনেই।

ফু ড়ু ৎ

রবিবারের সকালবেলা, বাজারে পা দিয়েই মন খুশি। সবাই ব্যাংক আর এ. টি. এম এর সামনে লাইন দিয়েছে, তাই ফাঁকা বাজারে হাত পা ছড়িয়ে সব্জি কিনলাম। দুহাতে বাজারের থলে নিয়ে বাড়ি ঢুকতে যাবো এমন সময় নিতাইদার দোকান…

Source: ফু ড়ু ৎ

ফু ড়ু ৎ

রবিবারের সকালবেলা, বাজারে পা দিয়েই মন খুশি। সবাই ব্যাংক আর এ. টি. এম এর সামনে লাইন দিয়েছে, তাই ফাঁকা বাজারে হাত পা ছড়িয়ে সব্জি কিনলাম। দুহাতে বাজারের থলে নিয়ে বাড়ি ঢুকতে যাবো এমন সময় নিতাইদার দোকানে নলেন গুড়ের মিষ্টিগুলো আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। আর যায় কোথায়, একবাক্স নলেন গুড়ের রসগোল্লা আর কাঁচাগোল্লা নিয়ে পকেট থেকে টাকা বার করে দিতে গিয়েই চিত্তির। দাম বেড়ে হয়েছে ডাবল। মিষ্টি কিনতে এসে মুখ তেঁতো করে বাড়ি ফিরলাম। চৌকাঠে পা দেব তখনি চোখে পড়লো, কালো কালো পিঁপড়ের সারি আমার ঘরের দেয়াল বেয়ে রাস্তায় নেমেছে, তারপর মহাসমারোহে নর্দমার পাশ দিয়ে পাশের গলিতে সেঁধিয়ে গেছে। মনে সন্দেহের উদ্রেক হতেই, ওদের মিছিলটাকে ফলো করতে থাকি নিঁখুত নৈপুণ্যে। “কি রে, তোরাও কি সব টাকা বদলাতে পথে নেমেছিস নাকি?”, নির্বাক বেতার তরঙ্গে প্রাণীগুলোকে জিজ্ঞেস না করে পারিনা। ওরা ব্যস্ত, আমাকে পাত্তাই দেয় না, চুপচাপ চলেছে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। কয়েক পা যেতেই আমার মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো, পিঁপড়ের লাইনটা নিতাই-এর মিষ্টির দোকানের পিছন দরজার ভিতরে অন্তর্ধান করছে। “আমার ঘরে বাস করে নিতাইএর লাভের গুড় খেয়ে ফাঁক করছিস তোরা!! তোদের মিশন সাকসেস্ফুল হোক!”, আমি খুশি মুখে বলি। আমি না পারি, পিঁপড়েগুলোতো আমার হয়ে নিতাই এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে? গোয়েন্দাগিরিতে ক্ষান্ত হয়ে বসার ঘরে পা দিতেই মনটা আরো উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। লেবু, আঁধুলি, হারু এবং গামছা সক্কলেই উপস্থিত। আমাকে ঢুকতে দেখেই হারু চিককুর ছাড়লো, “রনিনদা এসে গেছে, জলখাবারটা সেরে নেওয়া যাক। ” গামছা এবং লেবু একযোগে চিৎকার ছাড়লো, “বিহারীদা! কচুরি এবং সিঙ্গাড়া!”
আমার চোখ ছানাবড়া, নিজেই জানতাম না আমার ঘরে কি জলখাবার বানানো হয়েছে? আঁধুলি আমার নির্বাক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলো, “বিহারীদার হিঙের কচুরির গন্ধ শুকে আমি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে এখানে পৌঁছে যেতে পারি!”
“আহা, তোদের জন্য একটা সারপ্রাইস আছে কিন্তু!”, আমি গর্বিত ভাবে ঘোষণা করি। তারপর সুরুৎ করে বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করে বিহারিদাকে মিষ্টিগুলো দিয়ে দায়মুক্ত হই তারপর আবার বসার ঘরে পদার্পন। বিহারীদের হাতে জলখাবারের প্লেট। হারু আবার চিল চিৎকার ছাড়ে, “ওরে বাবা! নলেন গুড়ের রসগোল্লা!” আঁধুলি বাকরুদ্ধ, লেবুর মুখে কান এঁটো করা হাসি। আমি বিজয়ী আলেক্সান্ডার এর মতো মুখ করে বলি, “কি! কেমন দিলাম?” কোনো উত্তর নেই, সবাই নির্বাক কিন্তু তাদের মুখ চলছে ক্রমাগত। আমিও নিজেকে সামলে নিয়ে প্লেট পরিষ্কার করতে নেমে পড়ি। হঠাৎ করে গামছা বলে ওঠে, “এতো তাড়াতাড়ি নলেন গুড়? নিশ্চয় নকল হবে!” আমি জবাবদিহি করার আগেই, হারু ছোঁ মেরে গামছার মিষ্টির প্লেট কেড়ে নিলো, “থাক তোকে আর নকল নলেন গুড় খেতে হবেনা।” গামছা নিজের প্লেট বলপ্রয়োগে কেড়ে নিয়ে ঘোষণা করলো, “আসল না নকল, হু কেয়ারস! নলেন গুড় ইস নলেন গুড়!”

জলখাবার শেষ করে সবাই সিগারেট ধরালাম, তাস খেলায় কারো মন নেই। “বাপিদা চা প্লিজ!”, লেবুর ঘোষণা। চা খেতে খেতেই আঁধুলি স্মৃতি রোমন্থনের ভঙ্গিতে বলে উঠলো, “শীতকাল এলেই মনটা কেমন ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে!” “মানে?” হারুর চমৎকৃত প্রশ্ন। “আঃহা! ছোটবেলায় শীতকালে, কতজায়গায় ঘুরতে যেতাম তো, চিড়িয়াখানা, সার্কাস, গড়ের মাঠ, মেলা, মিউসিয়াম আরো কত কি!”, লেবুর ব্যাখ্যান। গামছাও আজ দার্শনিক, “আমার খালি ক্রিস্টমাসে কেকর গন্ধ মনে পড়ে আর সঙ্গে চড়ুইভাতি ! এন্তার মজা মাইরি!” আধুলিও চুপ থাকার নয়,”আমরা ছোটবেলায় শীতকালে আমাদের গ্রামের বাড়িতে যেতাম, সর্ষেক্ষেতের মধ্যে কুয়াশায় ঢাকা সকাল, সিম্পলি ভাবা যায়না!”

“আচ্ছা এবার শীতে, কোথাও একটু ঘুরে এলে হয়না?”, আমি দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে বলি। “আলবাত হয়!”, হাঁটু চাপড়ে গদির ওপর উঠে বসে হারু। “ইয়ে, আমার কথাটাও ভাবিস কিন্তু, ছুটি ফুটি আমরা বেশি পাইনা তো……”, গামছার কাতর স্বগতোক্তি। লেবু এবং আঁধুলিও এক পায়ে, মানে দু পায়ে খাঁড়া। “কিন্তু কোথায়?”, আমার প্রশ্ন। “কেন? উত্তরবঙ্গ! জলদাপাড়া!”, এবার গামছার তড়িঘড়ি উত্তর। সবাই এক কথায় রাজি। কিন্তু টিকিট? তারও উপায় হলো, সকলের পকেট থেকে ইলেকট্রনিক গুপিযন্ত্র বেরিয়ে পড়লো টপাটপ করে। “উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস, ১৩০ খানা সিট এভেইল্যাবল।”, হারুর ঘোষণা, লেবু যোগ দেয়, “কাঞ্চনকন্যা, ৭১টা।” আঁধুলির দাবি, “হাসিমারা দিয়ে যাবো কিন্তু। ওখানকার রাস্তাটা সুপার্ব।”
“আমার উপরের বার্থে ঘুম হয়না।”, আমার অনুনয়। গামছা হাত তুলে বরাভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে জানালো, “চিন্তা নেই, টিকিট কন্ফার্মড!”
“আমিও যাবো!”, বাপিদার মাফলার জড়ানো গোঁফেল মুখ উঁকি মারছে দরজায়। “আর আমি কি দোষ করলাম?”, এদিকে বিহারীদের অভিমান। আবার দুটো টিকিট কন্ফার্ম করা হলো। সকলেই খুশি। “আমি হোটেলের বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি, তোরা আমার ট্রেনের টিকিট কেটে রাখ!”, বিবেকদার আগমন এবং ঘোষণা। খুশি দ্বিগুন। জলদাপাড়া বিবেকদার হাতের তালুর মতো চেনা, তার উবাচ, “চিলাপাতা, টোটোপাড়া, বিন্ধু ঝালং আর একদিন হাতির পিঠে চেপে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে সাফারি। দুর্দান্ত হবে কিন্তু।” “থ্রী চিয়ার্স ফর রনিনের দফতর!”, হারুর হাত পা ছুড়ে চিৎকার। “হিপ হিপ হুররে!”, আমাদের সমবেত যোগদান।

আসর ভাঙলে আমি চানঘরে ঢুকি, গুন্ গুন্ করে গান গাই, “আজ মন চেয়েছে, আমি হারিয়ে যাবো… “, গায়ে জল ঢালতেই গান বন্ধ হয়ে যায়, কাকভেজা হয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বুঝি, শীতকালে চান করার আগে জল গরম করে নেওয়াই বাঞ্ছনীয়।

 

সং গ্রা ম

“দেখলে তো? শেষ অব্দি ট্রাম্পই ভোটে জিতলো?”, বিজয়ীর হাসি মুখে নিয়ে আমার বসার ঘরে গামছার প্রবেশ। আমি, হারু, লেবু এবং আঁধুলি তাস খেলতে মগ্ন। মুখ না তুলেই উত্তর দিই, “তা বেশ, কিন্তু এ…

Source: সং গ্রা ম